সঙ্কটের মুখে বিদেশি শ্রমবাজার
মো. ওসমান গনি
বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সাহায্য করে থাকে বিদেশি রেমিট্যান্স। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে সেই রেমিট্যান্সের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে।এর প্রধাণ কারণ হলো দক্ষ শ্রমিকের অভাব ও নতুন শ্রমিবাজারের অভাব। অতিরিক্ত টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে আমাদের দেশের শ্রমিকদের আসল টাকাও রোজগার করতে হিমশিম খেতে হয়। সেখানে গিয়ে তারা কাজ না পাওয়া বা কাজ পেলেও সে কাজের দক্ষতা না থাকার কারণে তারা কাজ করতে না পারাসহ অন্যান্য আনুসাঙ্গিক সমস্যায় পড়ে। অতিরিক্ত ব্যয় আর দক্ষতার অভাবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। নতুন নতুন সংকটে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত শ্রমবাজার। সঙ্কট মোকাবিলায় অভিবাসন ব্যয় কমাতে মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তে নতুন বাজার খোলার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা। বায়রা কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি উদ্যোগ ছাড়া তাদের একার পক্ষে নতুন নতুন বাজার খোলা সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারি প্রচারণায় আছে চলতি বছর বিশ্বের ৯৭টি দেশে কর্মী পাঠানো হয়েছে। অথচ এর মধ্যে ৩৮টি দেশে কর্মী গমনের সংখ্যা ১ থেকে ৯ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। আবার এদিকে কর্মী প্রেরণের সংখ্যা বাড়লেও ধস নেমেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে। গত বছরের তুলনায় এ বছর আড়াই লাখ কর্মী বেশি বিদেশ গেছেন। এর বিপরীতে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার মিলিয়র ডলার কম। অন্যদিকে আফ্রিকার মতো অতি দরিদ্র দেশেও কর্মী পাঠানো হয়েছে। সুদান, সোমালিয়ার মতো দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করা দেশে কর্মী পাঠানোয় সংশ্লিষ্ট মহলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলে চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। এদিকে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধুমাত্র সৌদি আরব ছাড়া প্রায় সবগুলো দেশেই কর্মী প্রেরণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিএমইটির পরিসংখ্যান মতে, এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত ওমানে কর্মী গমনের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ বছর দেশটিতে কর্মী গিয়েছিল ৮৩ হাজার ১৬ জন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৪৭ জন। কাতারে গেছে ৭৭ হাজার ১৪৫ জন যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৬০ হাজার কম। বাহরাইনে গত বছর গিয়েছিল ৭২ হাজার ১৬৭ জন। এ বছর নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজারে। লেবাননে গত বছর কর্মী যায় ১৫ হাজার ৯৫ জন। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত একই দেশে গেছে ৭ হাজার ৪০৭ জন। জর্ডানে কর্মী প্রেরণ ২৩ হাজার ১৭ থেকে নেমে গেছে ২০ হাজারে। সিঙ্গাপুরে ৫৪ হাজার ৭৩০ জন থেকে নেমে গেছে ৩৮ হাজারে। এভাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে যেসব দেশে বাংলাদেশের কর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে তার প্রায় সবক'টিই সংকুচিত হয়ে এসেছে। তবে মালয়েশিয়ায় গত বছরের তুলনায় এ বছর কর্মী প্রেরণ কিছুটা বেড়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কর্মী গেছেন ৯ লাখ ৩১ হাজার ৮৩২ জন। ১৯৭৬ সালে বিদেশে বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণ শুরু হওয়ার পর সংখ্যার দিক থেকে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৮ সালে কর্মী গিয়েছিলো ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন। কুয়েত আর মালয়েশিয়া ছাড়া অন্য সব দেশে কমছে বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণ। এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সেও। এছাড়া কিছু দেশে কর্মী গেলেও কাজ না থাকায় অনেকে বেকার সময় কাটাচ্ছেন। ব্যতিক্রম শুধু সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে চলতি বছর রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী গেছেন। এছাড়া অন্য দেশগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কাজের পরিসর ছোট হয়ে আসছে। সৌদি আরব ছাড়া প্রায় সকল দেশেই শ্রমবাজারে ধস নেমেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে এ যাবৎকালের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ কর্মী গেছে। গত নয় মাসে সেখানে কাজের সন্ধানে গেছে ৫ লাখ ১৩ হাজার ৮৬২ জন। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই বাংলাদেশি কর্মীদের একটি অংশ বেকার হয়ে পড়েছেন। কাজ না থাকার পরও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সৌদি আররে কর্মী পাঠানো হচ্ছে এমন অভিযোগ আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। চলতি বছরের কর্মী প্রেরণের হার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সৌদি আরবে কর্মী প্রেরণ অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও বেশিরভাগ দেশেই কমেছে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে ১৬৩ দেশে কর্মী পাঠানো হচ্ছে এমন ঘোষণা দিলেও বাস্তবে কোনো অগ্রগতি নেই। এদিকে সৌদি আরবে কর্মী প্রেরণের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সেদেশে বেকার হয়ে পড়ছে বাংলাদেশিরা। সৌদি আরবে দেশটিতে ফ্রি ভিসার নামে যারা গেছেন, তাদের প্রায় সবাই বেকার অবস্থায় দিন পার করছেন। এছাড়া আর্থিক মন্দার কারণে বিভিন্ন কোম্পানি থেকেও তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। এদিকে কর্মহীন কর্মীদের বেশ কয়েকজন জানান, কতিপয় রিক্রুটিং এজেন্সি শুধু টাকার লোভে কাজ না থাকা সত্ত্বেও প্রলোভন দিয়ে সৌদি আরব পাঠাচ্ছে। আমেলে মনজিল' ভিসা বা বাসাবাড়ির কাজ নিয়ে অনেকেই সৌদি আরব যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের কেউই কাজ পাচ্ছেন না। নির্দিষ্ট এই ভিসার কারণে বাসাবাড়ির বাইরে তাদের কাজ করার সুযোগ নেই। ফলে তাদেরকে অন্য কোথাও কাজ করতে দেখলে পুলিশ ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে আসায় কষ্ট হলেও পালিয়ে বেড়ায়। এছাড়া ফ্রি ভিসার নামে গিয়েও হাজার হাজার কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আমেলে মনজিল' ভিসায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট মালিকের বাসায় কাজ তো পাওয়াই যায় না, উল্টো প্রতি বছর তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হবে। তাদের অভিযোগ সে দেশে কাজ তো নেই-ই বরং আগে থেকে অনেকেই যারা কাজ করতো তাদের ছাঁটাই করে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মী প্রেরণ করা হচ্ছে দারিদ্র্যসীমার নিচেই বাস করা আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া ও সুদানেও। জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে সুদান গেছে, ১৫৭৪ জন। অন্যদিকে সোমালিয়ায় পাঠানো হয়েছে ১০৪ বাংলাদেশি কর্মীকে।
চলতি বছরে প্রায় ১০ লাখের অধিক কর্মী বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যা বাংলাদেশে অভিবাসন খাতের এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ সংখ্যক। এ বছর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ হতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট ৯ লাখ ৭৩ হাজার কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার মহিলা কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকারি হিসেবে চলতি বছর কর্মী প্রেরণের সংখ্যা বাড়লেও রেমিট্যান্স কমেছে। চলতি বছরের গত ৯ মাসের বিএমইটির তথ্যমতে, এ বছর প্রায় ২ লাখ কর্মী বেশি বিদেশে গেছে। গত বছর ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন প্রবাসী কর্মী রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন ১৩ হাজার ৬০৯ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলার। আর চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৩১ হাজার ৮৩২ জন কর্মী রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১২ হাজার ৩৫৯ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বছর শেষে রেমিট্যান্স ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদের মতে, এখনো দেশের সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। দ্রুত শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি হবে। যা দেশে স্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দায় রূপ নিতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার ছিল ৭৬টি দেশে সীমিত এবং বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে গেছে ১০ লাখ ৯২ হাজার ৩১৮ জন। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রফতানি বেড়েছে। বিশ্ব বাজারে দক্ষ শ্রমিকের কোনো বিকল্প নেই। নতুন করে ৫২টি দেশে লোক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০১৮ সলের মাঝামাঝির দিকে এর সুফল পাওয়া যাবে। নতুন শ্রমবাজার খোঁজার সাথে সাথে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বায়নের এ যুগে অদক্ষ শ্রমিকের তুলনায় দক্ষ শ্রমিকের কদর দিন দিন বাড়ছে। প্রতিযোগিতার এ যুগে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর কোনো বিকল্প নেই। শ্রমবাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে অভিবাসন ব্যয় বাড়ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিদেশ যাওয়া শ্রমিক। অধিক পরিশ্রম করেও অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকরা অভিবাসন ব্যয় তুলতে পারেন না।
মো. ওসমান গনি : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।