বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম জামায়েত বিশ্ব ইজতেমায় প্রতিবারের মত এবারও টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে জমায়েত হয়ে এক ইমামের পিছনে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান জুম্মার নামাজ আদায় করেছেন। ৫৩তম এ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম জুম্মার নামাজে ইমামতি করেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মো. যোবায়ের হোসেন। দুপুর ১টা ৪৫ মিলিটে আরম্ভ হওয়া নামাজ শেষ হয় ১ টা ৫৫ মিনিটে।
ইজতেমার প্রথম দিনে তাবলীগের লোকজনের সাথে সাথে তীব্র শীত উপেক্ষা করে পাশের জেলা ঢাকা,নারায়ণ'গঞ্জসহ গাজীপুরের লাখ লাখ মুসলি্ল ছুটে আসেন টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান প্রাঙ্গনে, দেশের সর্ববৃহৎ এ জুম্মার নামাজে অংশ নিতে। বাড়তি মানুষের চাপ ও যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ রাখতে ট্রাফিক থেকেও নেয়া হয় যথাযথ ব্যবস্থা। এদিকে বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে টঙ্গী সেজেছে নতুন রূপে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের ইজতেমায় মুসলি্লদের উপস্থিতি ছিল অনেকটাই কম। অন্যান্য বছরে জুম্মার নামাজে অংশ নিতে আসা মানুষ ময়দানে জায়গা না পেয়ে ময়দান সংলগ্ন সমস্ত ফাঁকা জায়গা ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহসড়কের আব্দুল্লাহপুর থেকে মন্নুগেট পর্যন্ত রাস্তায় নামাজ আদায় করতেন। কিন্তু এবার ময়দানের ভিতরে পর্যাপ্ত জায়গা ফাকা থাকায় মুসলি্লদের কিছু অংশ টঙ্গী স্টেশনরোড ওভার ব্রিজের নিচে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নামাজ আদায় করলেও ময়দানের ভিতরে পর্যাপ্ত জায়গা ফাকা ছিল। তবে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে ৫৩ তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম জুম্মা।
যে কারণে বিশ্ব ইজতেমা চার পর্বেঃ
২০০১ সালে বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসলি্লর সংখা ছিল ১০ লাখ, ২০১০ সালে যার পরিমাণ দাড়ায় ৫০ লাখে। পরে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটি ও সরকারের হস্তক্ষেপে ২০১১ সাল থেকে ইজতেমাকে ৩২ জেলা করে দুই ভাগে আয়োজন করা হয়। এতেও জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ২০১৬ সালে ১৫ জেলা করে একে চার ভাগে ভাগ করা হয়। ১৬ জেলা করে প্রতিবছল ৩২ জেলার মুসলি্ল বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন এবং বাকি ৩২ জেলার মুসলি্লরা নিজ নিজ জেলায় আয়োজিত ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। পরের বছরে নিজ জেলায় অংশগ্রহণকারী মুসলি্লরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিবেন এবং আগের বছরে বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী মুসলি্লরা নিজ জেলায় আয়োজিত ইজতেমায় অংশগ্রহণ করবেন।
ইজতেমায় প্রথম দিনে যারা বয়ান করেনঃ
বাদ ফজর শেখ ওমর খতিব এর আরবি বয়ানের বাংলা তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন। বাদ জুমা বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন, বাদ আসর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল বারি ও বাদ মাগরিব বয়ান করবেন বাংলাদেশের মাওলান মোহাম্মদ রবিউর হক।
ইজতেমায় বিদেশি মুসলি্লঃ
এবারের ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে গতকাল শুক্রবার সকাল ১১টা পর্যন্ত ৭৯টি দেশের ৩ হাজার ৯১৯ জন বিদেশি মুসলি্ল ইজতেমা ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার হারুন আর রশিদ এ তথ্য জানিয়েছেন। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, মোজাম্বিক, কানাডা, কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ইরান, জাপান, মাদাগাস্কার, নাইজেরিয়া, পানামা, মিসর, ওমান, সুদান, সৌদী আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, কাতার, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, মালি, সেনাগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাঞ্জেনিয়া, ত্রিনিদাদ, রাশিয়া, আমেরিকা, বেলজিয়াম, চীন, ফিজী, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, কোরিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, জর্দান, মৌরিতানিয়া, দুবাইসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুসলি্লগণ রয়েছেন।
ইজতেমায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা:
ইজতেমার পরিবেশ রক্ষায় ইজতেমায় প্রতিদিন ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই পর্বে পরিচালিত হবে। বিদেশি মুসলি্লদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে আলাদা খিত্তার ব্যবস্থা। সিসি ক্যামেরায় বিদেশিদের জন্য ৪টি খিত্তা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এবারের ইজতেমা ময়দানের রয়েছে ১৭টি প্রবেশ পথ। ইজতেমা ময়দানের চারদিকে ১৫টি ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। মাঠজুড়ে রয়েছে পোশাকের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের কড়া নজরদারি।
এদিকে গত বছরের ন্যায় এবারো বিশ্ব ইজতেমায় যৌতুকবিহীন গণবিবাহ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরবি্ব প্রকৌশলি মাওলানা মো. গিয়াস উদ্দিন।
ইজতেমায় আগত মুসলি্লর মৃত্যুঃ
গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে বুকের ব্যাথাজনিত কারণে আজিজুল হক (৬০) নামে এক মুসলি্লর মৃত্যু হয়েছে। নিহত আজিজুল হক মাগুড়া জেলার শালীখা উপজেলার খারিশপুর গ্রামের মৃত. আব্দুল কাওসারের পুত্র বলে জানা গেছে। অপর দিকে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টায় সড়কে বাস চাপায় আব্দুল্লাহ মামুন মনা (৩৩) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত মানা ঢাকার পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার কেরামত আলীর ছেলে।
প্রথম পর্বে অংশ গ্রহণকারী জেলা: বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে প্রথম ধাপে অংশগ্রহণ করেছেন ঢাকার একাংশসহ - ঢাকা (খিত্তা নং-১-৮), ১৬, ১৮, ২০ ও ২১), পঞ্চগড় (খিত্তা নং-৯), নীলফামারী (খিত্তা নং-১০), শেরপুর (খিত্তা নং-১১), নারায়ণগঞ্জ ( খিত্তা নং-১২ ও ১৯), গাইবান্দা (খিত্তা নং-১৩), নাটোর (খিত্তা নং-১৪), মাদারীপুর (খিত্তা নং-১৫), নড়াইল (খিত্তা নং-১৭), লক্ষ্মীপুর (খিত্তা নং-২২ ও ২৩), ঝালকাঠী (খিত্তা নং-২৪), ভোলা (খিত্তা নং-২৫ ও ২৬), মাগুরা (খিত্তা নং-২৭) ও পটুয়াখালীর মুসলি্লরা ২৮নং খিত্তায় অবস্থান করে তাদের ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকবেন। প্রত্যেকেই স্ব-স্ব খিত্তায় অবস্থান নিচ্ছেন। নির্দিষ্ট খিত্তায় নির্দিষ্ট জেলার মুসলি্লর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছর ১৬০ একর এলাকা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। বিদেশি মেহমানদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ৪ কামরা বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক নিবাস।
যাতায়াতে সুবিধা: মুসলি্লদের যাতায়াতের সুবিধার্থে অতিরিক্ত এসপি সালেহ উদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধানে ট্রফিক ব্যবস্থাপনা মনিটরিং করা হচ্ছে। চালু করা হয়েছে বিশেষ বাস ও ট্রেন ব্যবস্থা।
আগামীকাল ১৪ রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ৫৩ তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। ৪ দিন বিরতির পর ১৯ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২১ জানুয়ারি শেষ হবার কথা রয়েছে ২০১৮ সালের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব।
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।