আজ ফাল্গুনের সাথে একই দিনে পালিত হচ্ছে ভালোবাসা দিবস
শোয়াইব আহমেদ
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে সংশোধনের কারণে এবছর থেকেই বাংলা ফালগুন মাসের প্রথম দিন ও এই ভালোবাসা দিবস পালিত হচ্ছে একইদিনে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩ তারিখে ফালগুন মাসের
প্রথম দিন পালিত হতো, আর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় ভালোবাসা দিবস। তবে এখন থেকে দুটি দিবসই পালিত হবে একই দিনে। গত বছর ২৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে ২০২০ সালের সরকারি ছুটির তালিকার অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ছুটির তালিকা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। এইদিন বিশেষত রাজধানীজুড়ে ঢল থাকবে নানা বয়সী মানুষের। তরুণীরা বাসন্তি রঙের শাড়ি আর মাথায় হলুদ ফুল দিয়ে নিজেরদের নুতন করে সাজিয়ে তোলে। অন্যদিকে ছেলেরা সাজে হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে।
ভালোবাসা দিবস যা পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষের কাছে বছরের সুন্দরতম একটি দিন। যার অপেক্ষায় দীর্ঘ প্রহর গুণে প্রেমিক-প্রেমিকারা। দু'জনের সম্পর্কের জীবনের সুন্দরতম এই দিনের প্রকাশ ঘটে ফুলের মালা চুলে বেঁধে। প্রেমিক-প্রেমিকারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সাহচর্যে থাকে দিনভর। আড্ডা, ঘুরাঘুরি, সিনেমা দেখা, দর্শনীয় স্থানে গিয়ে সময় কাটানোসহ নানাবিধ উৎসবে পালন করে দিনটি। আবার অনেকে এ প্রেমের কারণে রাজ্যহারাও হয়েছেন ইতিহাসের বিভিন্ন পাতায়। ত্যাগ করেছেন রাজসিংহাসন। মনের ভেতরে গড়েছেন প্রেমের তাজমহল। আবার কেউ নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন অন্তহীন প্রাণের আবেগে। শীতের আড়ষ্টতা ভেঙে জেগেছে প্রকৃতি। দখিনা বাতাসে ভাসছে পাখিদের গান। হৃদয়ের ব্যাকুলতা নিয়ে এসেছে বসন্ত। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, 'হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্র-সঙ্গীতে যতো আছে, হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে বনের কুসুমগুলি ঘিরে।
একইদিনে প্রকৃতির দক্ষিণা দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। কোকিলের কণ্ঠে শোনা যাবে বসন্তের আগমনী গান। ফুলে ফুলে ভ্রমরের খেলা। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের রঙবেরঙের বিচিত্র মেলা। সব কিছুই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে জানান দিচ্ছে পহেলা ফালগুনের আগমনীর বার্তা। ফালগুনের হাত ধরেই ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি যেন আজ সেজেছে নানা বর্ণিল সাজে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ফালগুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল, ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল। চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়, বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়। স্পন্দিত নদীজল ঝিলিমিলি করে, জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি বালুকার চরে।
গতকাল সারাদিন দুটি দিবসকে সামনে রেখে শাহবাগ মোড়ে ফুলের দোকানগুলোতে দেখা যায় নানা রঙের ফুলে রাঙানো। রাজধানীর শাহবাগসহ আশপাশের অঞ্চলের পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের পদচারণা আর দর কষাকষিতেই মধ্যরাত পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। তবে দুই দিবস একসাথে থাকায় এবং মেট্রোরেলের জ্যাম থাকায় শাহবাগের এই ফুলের দোকানগুলোতে ভিড় কম।
বসন্তের এই আগমনে প্রকৃতি ও সকল মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা দিবস একইদিনে হওয়ায় তরুণ হৃদয়েও লেগেছে দোলা। সকল কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে বসন্তের উপস্থিতিতে সকলের প্রাণ আজ নতুন আঙ্গিকে দোলা দিচ্ছে। তাই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, 'ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।্থ আবাল-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী বসন্ত উম্মাদনায় আজকে মেতে উঠবে এইদিনে।
শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্ত বরণে চলবে ধুমধাম আয়োজন। রিক্ত হস্তে শীত চলে যাচ্ছে, আর বসন্ত আসছে সুসজ্জিত ফুলের ডালা সাজিয়ে। বসন্তের নানা ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা। বসন্তকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলায় মেলা, পিঠাপুলি, সার্কাসসহ নানা বাঙালি আয়োজনের সমারোহ থাকবে। গ্রামের মেঠো পথ, নদীর পাড়, বৃক্ষরাজি, মাঠভরা ফসলের খেত বসন্তে রঙিন হয়ে ওঠে। নিসর্গের বর্ণচ্ছটায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে অনন্য সাধারণ। ভালোবাসার মানুষের সাহচার্যপ্রাপ্ত হয়ে একই দিনে মন রাঙাবে বাসন্তি সাজেই। এদিকে, দিনটিকে আরো উপভোগ্য করে তুলতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্তকে অভিনন্দন জানিয়ে কবিতায় প্রকাশ করেন, আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে, করো না বিড়ম্বিত তারে/ আজি খুলিয়ো হৃদয় দল খুলিয়ো/ আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো'। কৃষণ চন্দর তার কবিতায় বলেন, ভালোবাসাটা হচ্ছে এক ধরনের প্রতিজ্ঞা। হুমায়ূন আহমেদ তার কবিতায় প্রকাশ করেন, সবাই তোমাকে কষ্ট দিবে, তোমাকে শুধু এমন একজনকে খুঁজে নিতে হবে যার দেয়া কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে। বাঙালির জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বসন্ত। বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায়। বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালি পালন করে 'পহেলা ফালগুন-বসন্ত উৎসব' হিসেবে। এ উৎসব সকল বাঙালির জন্য উৎসব। কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় ্তুপ্রেম হল ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন্থ বলে অভিহিত করেন। এ রাজধানী ঢাকার বুকে বাসন্তী সাজে তারা ঘুরে বেড়াবে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর, চারুকলা আর টিএসসিতে। এই দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিণত হবে মানুষের বাসন্তী রঙের প্রাঙ্গণে। রমনা পার্ক, জাতীয় সংসদ, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াবে রাজধানীবাসী।
একটি সপ্তাহজুড়ে অনুরাগের হরেক দিবস শেষে ভালোবাসার এই দিনটি আবির্ভূত আবির্ভাব হয়। বার্ষিক উৎসবের এই দিবসটি প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম অনুরাগের মাধ্যমে অথবা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে উদযাপিত হয়। এই দিনে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে ফুল, চিঠি, কার্ড, গহনা, টেডি প্রভৃতি উপহার প্রদান করে দিনটি উদযাপন করে থাকে। এর আগে পুরো একসপ্তাহ ছিল বিভিন্ন দিবস। সেগুলো হলোু ৭ ফেব্রুয়ারি : হ্যাপি রোজ ডে, ৮ ফেব্রুয়ারি : হ্যাপি প্রপোস ডে, ৯ তারিখ : হ্যাপি চকলেট ডে, ১০ তারিখ : হ্যাপি টেডি ডে, ১১ তারিখ : হ্যাপি প্রমিস ডে, ১২ তারিখ : হ্যাপি কিস ডে ও গতকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল হ্যাপি হাগ ডে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বলেন, সোহাগের সঙ্গে রাগ না মিশিলে ভালোবাসার স্বাদ থাকেনা। এছাড়াও আমার তৃষ্ণা তোমার সুধা, তোমার তৃপ্তি আমার সুধা ইত্যাদি দিয়ে ভালোবাসার অনুভূতি কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্যদিকে কবি টেনিসন বলেছেন, ভালোবাসা যা দেয় তার চেয়ে বেশি কেড়ে নেয়!
প্রিয় মানুষটির সঙ্গ আমরা কে না চাই? শৈশবে মা-বাবার আদর থেকে শুরু করে, বন্ধুর হাত ধরে বন্ধুত্ব এবং সবশেষে জীবন সঙ্গীটির হাত ধরা। আচ্ছা, যখন আমাদের মন খারাপ করে, কারো সঙ্গ পেতে ইচ্ছা করে তখন নিশ্চয়ই আমরা চাই প্রিয় মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতে, একাকিত্ব ভাগাভাগি করতে। আপনার প্রিয় মানুষটির একাকিত্বটা সরিয়ে দিতে আপনি না হয় তাকে একটি আলিঙ্গণ করলেন। অধিক ব্যস্ততায় মা-বাবাকে সময় দিতে পারছেন না, ফেব্রুয়ারির এই দিনটিতে শৈশবের স্মৃতিটা ফিরিয়ে আনুন আলিঙ্গণবদ্ধ হয়ে।
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।