হাজার হাজার মাদক মামলায় ব্যবসায়ীদের সাজা হচ্ছে না
এফএনএস
বহাল-তবিয়তেই দেশজুড়েই অপকর্ম চালিয়ে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মাদক ব্যবসায়িরা। দেশে হাজার হাজার মাদক মামলা হলেও মাদক ব্যবসায়িরা থেকে যাচ্ছে সাজার আওতার বাইরে। মূলত মাদকের রাসায়নিক পরীক্ষার অভাবেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ বিভাগের তথ্যানুযায়ী সারাদেশে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১১টি করে মাদক আইনে মামলা হয়। আর ওসব মামলা প্রমাণের জন্য উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যের রাসায়নিক পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হাজার হাজার মামলার আলামত পরীক্ষার জন্য দেশে রাসায়নিক পরীক্ষাগার আছে মাত্র একটি। কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে প্রতি মাসে গড়ে বিভিন্ন মাদক মামলায় প্রায় ৬ হাজার মাদকের নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য আসে। ওই হিসাবে দিনে ২০০টি এবং ঘণ্টায় ২৫টি মাদকের রাসায়নিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর তার বিপরীতে কেমিস্ট আছেন মাত্র ৫ জন। ফলে লোকবলের অভাবে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে কেমিস্টদের। অথচ ওই পরীক্ষার রিপোর্টের উপরই মাদক মামলায় গ্রেফতারকৃতদেরর সাজা হওয়া, না হওয়া নির্ভর করছে। পুলিশ বিভাগ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারাদেশে মাদকের ভয়াল বিস্তারের মধ্যে বর্তমানে ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে।
এমনকি ইয়াবার আগ্রাসনের কাছে প্রশাসনও অসহায় হয়ে পড়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নদী ও সড়ক পথ হয়ে ইয়াবার চালান পৌঁছে যাচ্ছে। আর এর বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও পাচারের নিত্যনতুন কলাকৌশলের কাছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহজেই পরাজিত হচ্ছে। আকার ছোট বলে হাতে হাতে এটি ছড়িয়ে পড়ছে পাড়া-মহল্লা, অলিতে-গলিতে। মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই আসছে ইয়াবার বড় বড় চালান। মাঝে মধ্যে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে ইয়াবার চালান ধরাও পড়ছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, যে পরিমাণ ইয়াবা ধরা পড়ছে তার অন্তত ১০ গুণ নিরাপদে পাচার হয়ে যাচ্ছে। একটি বেসরকারী সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিদিন রাজধানীতে ১২ থেকে ১৫ লাখ পিস ইয়াবা বেচাকেনা হয়। পাশাপাশি মাদকের স্রোতের মধ্যে আবার ঢুকে গেছে নকল ইয়াবা। মাদকসেবীরা ইয়াবার নামে যা ব্যবহার করছে, তার বড় অংশই নকল। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নকল ইয়াবা তৈরির কারখানারও সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে বিভিন্ন সময় রাসায়নিক পরীক্ষাতে উদ্ধার করা বেশিরভাগ ইয়াবায় এর মূল উপাদান পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় ২০০০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারটি নির্মিত হয়। ওই ১৭ বছরে মাদকের বিস্তার ঘটেছে কয়েক গুণ। বেড়েছে মাদকের মামলার সংখ্যা, কিন্তু বাড়েনি মাদক পরীক্ষার ল্যাব, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, জনবল। সময় মতো রিপোর্ট দিতে না পারায় মাদকের মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বেড়েই চলেছে। যার সুযোগ নিচ্ছে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীরা। সারাদেশে প্রতিমাসে গড়ে ৬ হাজার মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়। ওই হিসাবে প্রতিঘণ্টায় গড়ে মামলা হচ্ছে ১১টি। কিন্তু মাদকের মামলায় সাজা হয়েছে এমন খবর মাসেও একটা পাওয়া যায় না।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১৪ সালে সারাদেশে শুধুমাত্র র্যাবের হাতে ধরা পড়ে সাড়ে ৪ হাজার ইয়াবা ব্যবসায়ী। ২০১৫ সালে ওই সংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ হাজার। তারপরের বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে ওই সংখ্যা বাড়তেই থাকে। তার মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও আছে। কিন্তু ওসব গ্রেফতারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার খুব একটা অগ্রগতি না হয়ে বরং ঝুলে আছে। বড় বড় চালান উদ্ধারের মামলার আসামিও জামিনে বেরিয়ে এসে আবার পুরনো ব্যবসা নেমে পড়ছে। ফলে দেশে হু হু করে বাড়ছে মাদকের বিস্তার। কয়েক বছর আগে মাদকসহ আটক করে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এমন মাদক ব্যবসায়ীরা এখনো চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে কয়েক বছরের বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। অথচ সবগুলো মামলাই বিচারাধীন। জামিনে বেরিয়ে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা দিব্যি আগের মতোই ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রতিদিন নতুন নতুন বিক্রেতার সৃষ্টি হচ্ছে। আর পুরাতন ব্যবসায়ীরা বার বার মামলার আসামী হওয়ায় তাদের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। এতে করে সাধারন মানুষ তাদেরকে ভয় পায়। এদিকে এ প্রসঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা জানান, পরীক্ষাগার থেকে সর্বোচ্চ কম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করা হয়। গতবছর ৬৭ হাজার ৭শ' ১৩টি রিপোর্ট দেয়া হয়েছে, যার সবগুলোই পজিটিভ। প্রতিষ্ঠানটিতে জনবল সঙ্কট আছে। তারপরও কম জনবল নিয়ে বেশি কাজ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভর করে মাদকের প্রসার ঠেকানো যাবে না। সেজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। মাদকের প্রসার ও বেচাকেনা ঠেকাতে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। পুলিশও সে লক্ষ্যে কাজ করছে।
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।