বৃষ্টির পানিতে ডুবেছে কুমিল্লার কৃষকের স্বপ্ন। গত কয়েকদিনের হালকা, মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাতে তলিয়ে যাত্তয়া মাঠের ধান নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন কৃষকেরা। একদিকে শ্রমিক সঙ্কট, অপরদিকে বোরো ধান কেটে বাড়ি আনতে তিনগুণ পরিশ্রমের পরও সোনালি ফসল ঘরে তুলতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কুমিল্লার কয়েকটি উপজেলার হাজার হাজার কৃষককে। এছাড়াও থেমে থেমে আসা বৃষ্টির কারণে আগে কেটে রাখা ধানও মাড়াই করে শুকাতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। চোখের সামনেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কষ্ট করে সৃজিত হাজার হাজার একর জমির ধান। ফলে কৃষকের বুকে জমছে চাপা আর্তনাদ।
চোখে-মুখে ফসল হারানোর শঙ্কার ছাপ। কুমিল্লার কিছু কিছু এলাকায় অতিবৃষ্টিতে ধান গাছ নুয়ে পড়েছে, আবার কোথাও ভেসে গেছে, ঝড়ের আঘাতে ঝরে গেছে ধান, কোথাও ভারী বৃষ্টিতে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে পাকা ধান। বৃষ্টি শুরুর আগেই যাদের ধান কাটা শেষ হয়েছে তাদের অনেকেই ধান শুকাতে পারেনি। ফলে গন্ধ হয়ে গেছে ধানে। বৃষ্টি ভেজা ধান ও গাছে আক্রমণ করেছে ছত্রাক। শুকাতে না পারায় কিছু ভেজা ধান থেকে অঙ্কুর (অঙ্কুরোদগম) বেরিয়েছে।
ফলে ঐ ধান গবাদি পশুকে খাওয়ানো ছাড়া আর কোনো কাজে আসছে না কৃষকের। এদিকে, বৃষ্টির কারণে ধান ভিজে গেলে সেই ধান আর গোলায় রাখা যায় না। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধ করে চাল করতে হয়। এমন ধানের চালের রংও কিছুটা লালচে হয়। নষ্ট হয়ে যায় স্বাদও।
জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, কুমিল্লায় এ বছর বোরোর আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৪৫৭ হেক্টর জমিতে। যা ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর বেশি। তেমনিভাবে ফলনও ছাড়িয়ে গেছে লক্ষ্যমাত্রা। হেক্টর প্রতি ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪.৯ টন। অথচ গত কয়েকদিনে মাঠ ঘুরে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। ফলন ভালো হলেও গত ক'দিনের বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় অধিকাংশ জমির ধান মাটির সাথে শুয়ে গেছে। আর ভারী বৃষ্টিতে পানি জমে যাওয়ায় অনেক জমির ফসলই তলিয়ে গেছে। ফলে একদিকে যেমন ছড়া থেকে ধান ঝরে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, তেমনি পানিতে তলিয়ে মাটিতে শুয়ে থাকা এসব ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যেতে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে-গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বরকইট গ্রামের কৃষক মোমেন মিয়া জানান, এবার বোরো ধানের আবাদ খুব ভালো হয়েছিল। গত কয়েক দিনের ঝড়-বৃষ্টির কারণে জমির ধান মাটিতে পড়ে গেছে। জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হবে। ধানের খেতে পানি থাকায় শ্রমিকরা ধান কাটতে মাঠে নামতে পারছে না। বেশি টাকা দিয়েও মিলছে না ধান কাটার শ্রমিক। কাদুটি গ্রামের কৃষক কামরুল জানান, জমিতে পানি জমে থাকায় ধানগাছগুলো পানির নিচে। শেষমেশ কতটা ধান থাকবে, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছি। মুরাদনগর উপজেলার বাবুটিপাড়া গ্রামের কৃষক আমিরুল ইসলাম জানান, চলতি বছর বোরো খেতের ধানের পাক ধরলে কয়েকদিনের ঝড়োবৃষ্টিতে খেতের ধান গাছ মাটিতে শুয়ে পড়ে। এরপর আবার ভারী বর্ষণ হওয়ায় সব খেতগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
এ এলাকার অধিকাংশ খেতগুলোতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে পড়ে যাওয়া ধান থেকেই আবার কলিয়ে গাছ বেরিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। বেড়ে যায় কৃষি শ্রমিকের মজুরি। ফলে কৃষকেরা খেতের ধান নিয়ে পড়েন চরম বিপাকে। খেতে পড়া ধানে ফলন কমে যায়। অনেক কৃষক ধারদেনা করে মাঠে ধান চাষ করে খরচের টাকাও ঘরে উঠাতে পারেননি। যে কারণে এখন আকাশে মেঘ জমলে কৃষকদের সব সময় ভয় হচ্ছে কখন জানি কি হয়। দাউদকান্দি উপজেলার বায়নগর গ্রামের বোরো চাষি বকুল হোসেন জানান, চলতি বছর প্রায় দুই একর জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন।
কষ্টার্জিত ফসল ঘরে তোলার আগেই বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে তার জমির পাকা ধান। এতে ধানের সঙ্গে ডুবেছে এ কৃষকের স্বপ্নও। ফলে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি। একই অবস্থা দেবিদ্বার, বরুড়া ও বুড়িচং উপজেলার কৃষক আমির হোসেন, জাকির হোসেন, মনির হোসেনসহ প্রায় তিন শতাধিক কৃষকের। ধারদেনা করে বোনা ফসল এভাবে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের। স্থানীয় কৃষকরা জানান, গত ২৯ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত ভারী বর্ষণে এ কুমিল্লায় প্রায় দুই শতাধিক গ্রামে বোরো ফসলের জমিতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। একই চিত্র দেখা গেছে, বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ও বাকশিমুল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে। অনেক গ্রামে এখনো অর্ধেকেরও বেশি ফসল রয়ে গেছে কাটা-মাড়াই ও শুকানোর বাকি। তারা চেয়ে আছেন প্রকৃতির উপর। যদি আকাশের মেঘ কেটে সোনালি সূর্য হাসে, তবে সামান্য হলেও ভোগান্তি কমবে তাদের। সৃজিত ফসলে লাভ না হোক, অন্তত হিসেবের খাতায় লসের অঙ্ক কষতে হবে না কুমিল্লার এসব প্রান্তিক কৃষককে।
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।