আলহাজ্ব মো. রবিউল হোসেন
তনিই ভাগ্যবান যিনি এক রমজান থেকে আরেক রমজান পাওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় বাগআঁচড়া জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. খায়রুল আলম বারবার এমন কথা উল্লেখ করতেন রমজান মাস দুয়ারে আসার পূর্বে (বর্তমানে চলমান রমজান) কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, রমজান মাসের গুরুত্ব এতোই যে, কোনো ব্যক্তি রমজান মাসে যদি একটি গুণাহ করেন, তাহলে তার আমলনামায় মাত্র একটি গুণাহ লেখা হয়। অথচ যদি কেউ একটি নেক বা ভালো কাজ করেন তাহলে মহান আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হয়ে নিজ হস্তে ঐ ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করবেন। অর্থাৎ এ ব্যক্তির জন্য বরাদ্দ হবে অগণিত সোয়াব। এক্ষেত্রে এ কথাই প্রমাণ করে আল্লাহপাক যেমন কঠোর তেমনি ভালো মানুষ বা নেককার বান্দাদের নেক কাজের ক্ষেত্রে তিনি দয়ার সাগর।
অনিবার্য কারণে আল্লাহর নৈকট্য, তার দিদার লাভের ও আধ্যাত্মিকতার উন্নয়ন, যা রমজান মাসের মূল লক্ষ্য, তা সবই এ মাসের ইবাদতের ফল। আর কতোই না উত্তম হতো যদি রমজান মাসের ইবাদতের দ্বারা এরূপ গভীর চিত্র আমাদের মানসপটে এবং এই সঙ্গে ইবাদতের যে অভ্যাস তা আমাদের মাঝে সারা বছর বজায় থাকতো।
বলা বাহুল্য যারা বা যে ব্যক্তি রমজানের গুরুত্ব কতো বা কতোটুকু এর অর্থ বোঝেন তারাই আফসোস করেন আহ্ সারা বছরই যদি এই মহান ফজলিতের মাস অর্থাৎ রমজান মাস থাকত। যারা রমজান মাসের পুরো গুরুত্ব বেঝেন না দেখতে পাই তাদের ক্ষেত্রেই এ সমাজ সংসারে নিত্য যা ঘটে বা ঘটছে_
যেমন, কেউ রোজা রাখেন আবার কেউ রাখেন না। কেউ প্রথম রোজা রেখে দ্বিতীয়, তৃতীয় রোজা ভঙ্গ করেন। কেউ পূর্ণ রোজা রাখলেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন না। কেউ রোজা বা রমজান এলে রোজাও রাখেন এবং নামাজও পড়েন। রমজান শেষ হলে আবার নামাজ পড়া ছেড়ে দেন। মসজিদে রাতের তারাবিহ নামাজ পড়তেও (২০ রাকাত) বিচিত্র দৃশ্য লক্ষণীয়। কেউ আট রাকাত নামাজ পড়ে পেছন থেকে সরে পড়েন। কেউ বা ১২ রাকাত পড়ে সরে দাঁড়ান। আবার অনেকেই খতম তারাবিহ না করে বাড়ি ফেরেন না। কেউ রোজা রেখেই মিথ্যা বলছেন। কেউ বা রোজা রেখে টুপি মাথায় দিয়েও ঘুষ চাচ্ছেন। হায়রে দুনিয়াদারি!
অথচ রাসুল করিম (সা.) তিনি বলেছেন, এক রমজান আরেক রমজানের আগমণ পর্যন্ত সকল গুণাহর কাফফারার মাধ্যম হয়ে থাকে। অন্য একটি হাদিসে উল্লেখ আছে_ যখন দেখবে রমজান মাস নিরাপদে চলে গেছে। তা হলে মনে করো সারা বছর তোমার জন্য নিরাপদ।
অনিবার্য কারণে সারা বছরের শান্তি, নিরাপত্তা ও নিরাপদের খাতিরে রমজানের পবিত্রতা ও এর অধিকারের প্রতি আমাদের অনেক বেশি যত্নবান হওয়া উচিৎ। রমজান মাসের ইবাদতগুলোর শর্ত মেনে তা আদায় করা প্রয়োজন। রমজানের রোজা ইবাদতের দরজাস্বরূপ। এ সম্পর্কে হযরত নবী করিম (সা.) বলেন, প্রত্যেক জিনিসের একটি দরজা থাকে, আর ইবাদতের দরজা হলো রোজা। এই রমজান মাসে এমন তিনটি ইবাদত রয়েছে, যা একজন মানুষকে সত্যিকারের মুমিনে পরিণত করতে পারে। এই ইবাদতগুলো সঠিকভাবে আদায় করার মাধ্যমে একদিকে যেমন আমাদের নৈতিক ও শারীরিক উন্নতি সাধিত হবে, অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতার এক পবিত্র স্রোতধারা প্রত্যেকের হৃদয়ে প্রবাহিত হতে থাকবে। তিনটি ইবাদতে সমৃদ্ধ রমজান। সেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মধ্যে প্রথম ইবাদত হলো_
* নামাজে তাহাজ্জুত।
* দ্বিতীয় লাইলাতুল কদর।
* তৃতীয়টি ইতেকাফ।
উল্লেখ্য, প্রতিটি বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ ছাড়া যেমন কোনো কাজে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয় : তেমনি রোজা, নামাজের গুরুত্ব না বুঝে শুধুমাত্র দায়সারা দায়িত্ব পালন করে কতটুকু সফলতা অর্জন করা সম্ভব?
মাওলানা খায়রুল আলম তাই মজসিদে প্রায়শই বলে থাকেন, আপনি পরীক্ষা দিচ্ছেন, কিন্তু অর্ধেক বা তারও কম প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বাড়ি চলে গেলে কি পাস করতে পারবেন? আপনি যে অফিসে প্রতিদিন কাজে যান, সেই কাজের সময় ১০-৪টা পর্যন্ত। কিন্তু প্রতিদিন ১০টা পর্যন্ত কাজ করে যদি বাড়ি ফেরেন তাহলে কি মাসের পূর্ণ বেতন পাবেন? না চাকরিটাই হারাবেন! তাহলে স্বভাবতই ভাবুন তো_
রমজান মাসে আমরা সবাই কমবেশি নামাজ পড়ি বটে; কিন্তু তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ি কয়জন?
লায়লাতুল কদরের নামাজ পড়ি কতজন? অর্থাৎ তারাবিহ নামাজের পর বাড়ি ফিরে রাতভর বা মধ্যরাত পর্যন্ত ইবাদত করি কতজন? আর ইতেকাফ? সেতো ক্যানভাসের প্রয়োজন ইমাম সাহেবদের। তারপর বহু কথা বা বাক্য ব্যয় করে মহল্লার ১/২ জন বৃদ্ধ মানুষ ছাড়া কয়জন ইতেকাফ করে থাকেন?
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সকলের জন্য আদায় করা ফরজ- কর্তব্য। এটি আল্লাহ পাকের আদেশ। কিন্তু এমন এক নামাজের কথা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদায় করতে বলেছেন, যাতে তিনি মুমিনদের এই সুসংবাদ দিয়েছেন যে, 'অচিরেই তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানস্বরূপ তোমাকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করবেন (সুরা বনি ইসরাইল আয়াত : ৭৯) আর সেই মহান বরকতময় ইবাদত হলো_ নামাজে তাহাজ্জুত। রমজান মাসে যদি অধিক নফল ইবাদত করা যায় তাহলে তা হবে একজন মুমিনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
এ পবিত্র মাসে নামাজে তাজাজ্জুতের ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের আগ্রহে ও সওয়াবের নিয়তে রমজানের রাত্রিতে উঠে নামাজ আদায় করে তার সকল গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। (বোখারি)। এ সম্পর্কে আরও একটি হাদিস উল্লেখযোগ্য তা হলো মহানবী বলেছেন, 'আমাদের প্রভু প্রতিপালক আল্লাহ রাতের এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ হন, তখন তিনি তার বান্দাদের সম্বোধন করে বলেন, 'কে আছ যে আমার কাছে কিছু চায় আর আমি তাকে তা দান করি। কে আছে যে আমাকে ডাকে আর আমি তার ডাকে সাড়া দিই। কে আছে যে আমার কাছে ক্ষমা চায়, আর আমি তার ক্ষমা করে দিই।
অতএব এ কথা অতীব সত্য যে রমজান মাসেই আল্লাহ পাকের মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিটি মুমিন মুসলমানের যে অপূর্ব সুযোগ রয়েছে তা অনেকেরই না জানার অজুহাতে বা কারণে বঞ্চিত হতে দেখা যাচ্ছে।
লাইলাতুল কদরের রাত সর্বোচ্চতম রাত বলে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। এই রাতের ইবাদত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।
তৃতীয়টি সাধনা ও সংযমের ইবাদত হলো ইতেকাফ। ইতেকাফের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর পথে একদিন ইতেকাফকারী ব্যক্তি ও জাহান্নামের মাঝে আল্লাহ এমন ৩০টি পরীক্ষা তৈরি করেন, যেগুলোর একটির সাথে অন্যটির দূরত্ব পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের চেয়েও বেশি হয় (বোখারি)। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, 'মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফে বসতেন আর এর ধারাবাহিকতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বজায় রেখেছিলেন।
পরিশেষে তাই বলি, আমরা সবাই ধর্ম মানি। কিন্তু মানার মতো মানি কয়জন? আমরা অনেক কিছুই জানি কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুই জানি না।
ধর্মীয় চেতনা এক। ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে জানা আর এক। তাই সকল বিষয় পূর্ণ জ্ঞান নিয়ে ইবাদত করলে যে ফল ফলবে অপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে অপূর্ণ ইবাদত করলে সে ফল ফলবে কী? ইবাদত সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান লাভের এ মুহূর্তে পূর্ণ সুযোগের যেন আমরা সৎ ব্যবহারের সচেষ্ট হই_ এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। আল্লাহ সহায় হোন।
আলহাজ্ব মো. রবিউল হোসেন : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।