জনতার মত
শিক্ষা খাতের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার লাগাম টানুন
খন্দকার আজিজুল হক
শিক্ষায় আলো, শিক্ষায় মুক্তি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এতেও সন্দেহ নেই যে জাতি, যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। আমাদের দেশও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বহুদূর চলে গেছে। দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জনটা হলো, সর্বস্তরের মানুষের কাছে তা পৌঁছাতে পারা। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, যে শিক্ষা রাষ্ট্র দিচ্ছে, সেই শিক্ষা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পেরে উঠছে না। হতাশা বাঁধছে তরুণ প্রজন্মে।
শিক্ষিত হয়েও চাকরি পাচ্ছে না। প্রতি বছর ২২ লক্ষ তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলেও তাদের বেশিরভাগই কাজ পাচ্ছে না। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সকলের আশ্বাস কমে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, দেশের সর্বত্রই চোখে পড়ছে কোচিং-বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা। যেখানে, শিক্ষার্থীদের বানানো হচ্ছে ক্রেতা আর তথাকথিত শিক্ষিতজনরা হচ্ছে বিক্রেতা। সরকারের কার্যকর উদ্যোগের অভাবেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্যের সূত্রপাত হয়েছে। স্বাধীনতার পর কয়েক দফায় পর পর শিক্ষানীতি প্রণিত হলেও কোনোটা বাস্তবে শতভাগ প্রয়োগ হয়নি। শুধু শিক্ষানীতিই প্রণিত হচ্ছে, তা কার্যকরের সময় হচ্ছে না সরকারের। শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেটের খুব নগন্য অংশই ব্যয় করা হয়। যেখানে মোট বাজেটের ১৫%-২০% ব্যয় করা দরকার ছিল।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা স্তরে স্তরে বিন্যস্ত। ফলস্বরূপ দিতে হচ্ছে চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষা। তারমানে এই দাঁড়ায়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা শুধু মাত্র পরীক্ষা-কেন্দ্রিক হয়ে গেছে, জ্ঞানভিত্তিক হতে পারেনি। পাবলিক পরীক্ষার মূল লক্ষ বরাবরই দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তা নেই। এখানে পরীক্ষায় লিখলেই পাস করা যায়। হোক সঠিক কিংবা ভুল। পাসের হার বাড়ানোর ফলস্বরূপ কমছে প্রকৃত শিক্ষিত জনের পরিমাণ। কমছে তাদের দক্ষতা। আজকাল দেখা যায়, একজন উচ্চ শিক্ষিত যুবকও ইংরেজিতে নিজের পরিচয়টা দিতে পারে না ঠিক করে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি না করিয়ে করছে পাসের সংখ্যা বৃদ্ধি। যার প্রভাবটাও পরবে সুদূরপ্রসারী। অতি মাত্রায় পাবলিক পরীক্ষা হওয়াতে, আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে কোচিং বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হচ্ছে কোচিং করতে। এ থেকে মুক্তি কবে হবে, কে বা জানে?
ফলে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জন করার প্রবণতা হারিয়ে মুখস্থ বিদ্যায় ঝুঁকে পড়ছে। বাড়ছে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি। দশ বছর আগের শিক্ষাব্যবস্থা আর আজকের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে যে বিষয়টা চোখে পড়বে, তা হলো, শিক্ষার গুণগত মান। শিক্ষার মান কতটুকু অক্ষুণ্ন থাকতে পেরেছে? প্রশ্নটা সকলের কাছে রেখে দিলাম।
চারটা পাবলিক পরীক্ষা দেয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কিংবা প্রকৌশলে ঢোকার জন্য নতুন করে পরীক্ষা দিতে হয়। এর মানে আমাদের চারটা পাবলিক পরীক্ষায় ত্রুটি রয়েছে। নইলে নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কিংবা প্রকৌশলে ঢুকতে হচ্ছে কেন?
শিক্ষার এই দূরবস্থার কথা সকলেরই জানা, তা আর বলার বাকি রাখে না। যেখানে, শিক্ষকরা শিক্ষাব্যবস্থার চালিকাশক্তি, সেখানে তারাই বা কতটুকু চাহিদা মেটাতে পারছে? সরকার শিক্ষকদের সামর্থ্যনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করলেও তার ফল তেমন হচ্ছে না।
নিয়োগ বাণিজ্যের ফলে, যোগ্যজন চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া শিক্ষকদের মনিটরিং ব্যবস্থাও ততটা জোড়ালো না। আজকাল শিক্ষিতজনদের নৈতিক অধঃপতন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের এই আচরণ মেনে নেয়া যায় না।
তারা শিক্ষিত হলেও সমাজকে পিছনে টানছে। তার কারণটাও সকলের জানা। মোটা দাগ দিয়ে বলা যেতে পারে, শিক্ষা খাতের দুর্নীতির কথা সকলেরই জানা। ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য তো আছেই। শিক্ষা খাতের দুর্নীতি মেনে নেয়ার মতো না। আজকাল উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও ভর্তি জালিয়াতির কথা শুনা যায়। যারা দুর্নীতির মধ্যে থেকে শিক্ষিত হচ্ছে, তারা সমাজকে কতটুকুই বা আলো দিতে পারবে?
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল দশা আর এগুতে দেয়া উচিত হবে না। এর লাগাম এখনি টানতে হবে। নইলে এ শিক্ষা জাতির মেরুদ- সোজা রাখতে পারবে না।
খন্দকার আজিজুল হক : লেখক
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।