বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে মায়ানমারের সেনা মোতায়েনের ঘটনায় বাংলাদেশ এটাকে সন্দেহের চোখেই দেখছে। বাংলাদেশ মনে করে, এর ফলে নতুন কোনো সংকট তৈরি হতে পারে। একারণেই ঢাকাস্থ মায়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সন্দেহজনক এসব তৎপরতা বন্ধ করে দুই দেশের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি অবসানের জন্য মায়ানমারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে গণহত্যা শুরুর প্রাথমিক পর্বে সেখানে সেনাদের জড়ো করেছিল মায়ানমার। গত শুক্রবার ভোরে শুরু হওয়া এই সেনা সমাবেশের কারণে রাখাইনে এখন যেসব রোহিঙ্গা রয়েছেন তাদের মধ্যে নতুন করে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সীমান্তের তিনটি পয়েন্টে ট্রলার থেকে সেনাদের নামানো হয়। যা সীমান্ত পয়েন্টগুলোর মধ্যে অন্তত একটির দূরত্ব আন্তর্জাতিক সীমান্তের ২০০ মিটারের মধ্যে। ওই তিন পয়েন্টে মাছ ধরার ট্রলারের কাঠের নিচে বসিয়ে সেনাদের জড়ো করা হয়। মায়ানমারের সেনাদের বাংলাদেশ সীমান্তে মোতায়েনের একাধিক কারণ থাকতে পারে। একটা কারণ হতে পারে, সেনা সমাবেশ বাড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতি আরো জোরদার করা। আরেকটা কারণ হতে পারে, তিনচার বছর ধরে, বিশেষ করে যারা ২০১৭ সালের আগস্টের রোহিঙ্গা গণহত্যার অপারেশনে যুক্ত ছিল, তাদের দ্রুত সীমান্ত থেকে সরিয়ে নেয়া। বিশেষ করে আইসিসিতে দুই সেনার জবানবন্দি রেকর্ডের পর থেকে পুরোনো সেনাদের মায়ানমার সরকার সীমান্ত থেকে ফেরত নিতে মরিয়া। নতুন করে আর কোনো সেনা যাতে পক্ষ ত্যাগ করতে না পারে, সে বিষয়ে মায়ানমার জোর দিচ্ছে।
ওদিকে রাখাইনে ফের আগুন জ্বলছে। তিন বছর আগে গ্রামে গ্রামে পাহারা বসিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে রোহিঙ্গাদের তাড়াতে যে বৌদ্ধরা (মগরা) বর্মী সেনাদের সহায়তা করেছিল এখন তাদের সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মিকে উচ্ছেদের টার্গেটে অপারেশন চালাচ্ছে মায়ানমার আর্মি।
বর্মী বাহিনীর টার্গেটে পরিবর্তন এলেও অশান্ত রাখাইন পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হিসাবেই থাকছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে মায়ানমার সেনাদের সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিলে সীমান্তে আশ্রয় প্রার্থনাকারী রোহিঙ্গা ও মগদের চাপ বাড়তে পারে। গত মার্চ থেকে রাখাইনে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্তত ১০টি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে বর্মী বাহিনী।
এদিকে, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে মায়ানমারের সেনা মোতায়েন জোরদার করার জের ধরে দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে ঢাকা। ঢাকাস্থ মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদপত্র দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি (মায়ানমার উইং) দেলোয়ার হোসেন একটি গণমাধ্যমকে বলেন, মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতের কাছে সীমান্তে সেনা সমাবেশ জোরদার করার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি যে কোনো ধরনের উষ্কানিমূলক কর্মকা- থেকে বিরত থাকতে এবং দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে মায়ানমার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে ঢাকা।
এর আগে ২০১৭ সালে সীমান্তে সেনা সমাবেশ জোরদার করে মায়ানমার। সে সময় দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যাসহ নানা ধরনের নির্যাতন চালায় দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এর জের ধরে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এদিকে, মায়ানমার সীমান্তে সেনা মোতায়েনের ঘটনায় বাংলাদেশের কী ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি মায়ানমার সীমান্তে তাদের সরকার মাঝে মাঝেই সৈন্য সামন্ত বৃদ্ধি করে বা অবস্থান করেন। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের জানানো হয়েছে। তাদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে আমাদের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে সেনা মোতায়নের কারণের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া আমরা আমাদের পক্ষ থেকে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রয়েছি। এটা নতুন কিছু নয়।
সীমান্তে সেনা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আর আমরা সবসময় প্রস্তুত থাকি। আমাদের রোহিঙ্গাসহ নানা সমস্যা রয়েছে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করে যাচ্ছেন। আমাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। প্রধানমন্ত্রীসহ বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা চলছি।
বিজিপি ও বিএসএফের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিজিপি ও বিএসএফ আলোচনা প্রতিবছরই হয়। সেখানে আমাদের বিজিপির ডিজি যান ও তারাও আসেন। এই প্রক্রিয়া চলমান। আমরাও ভারতে গিয়ে থাকি, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও আসেন। আমাদের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক আছে। তারিখ তো পরিবর্তন হতেই পারে যেকোনো কারণে। আগরতলা-আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সম্পর্কিত চুক্তি অনুযায়ী সৈন্য সমাবেশের কারণ বা উদ্দেশ্য জানানোর কথা থাকলেও মায়ানমার বাংলাদেশকে তা জানায়নি। মায়ানমার তাদের অভ্যন্তরীণ কোনো সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতবাদী গোষ্ঠীর জন্য সৈন্য সমাবেশ করলেও সীমান্তের কাছে হওয়ায় তা বাংলাদেশকে জানানো উচিত ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলছেন, আমার ধারণা মায়ানমারের পক্ষ থেকে এটা সম্পূর্ণই ডোমেস্টিক কারণ হতে পারে। কিছুদিন আগে কিন্তু আমরা দেখেছি দুই জন মায়ানমার সেনা আন্তর্জাতিক আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে, তারা যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করেছে, এটা তারা ওপরের মহলের নির্দেশে করেছে। তারা এখন দৃষ্টিটা ঘুরাতে চাচ্ছে কিনা-সেটাও কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হবে।
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।