বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ! প্রয়োজন প্রতিরোধ
মো. ওসমান গনি
তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ সমাজের একটি মারাত্মক ব্যাধি। ইসলামী বিধানমতে,স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল থাকলে তালাক দেয়ার নিয়ম থাকলেও এটি একটি নিম্মমানের কাজ। ইদানীং আমাদের দেশে তালাক দেয়ার প্রবণতাটা আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি বেড়ে গেছে। এখন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় তালাকের হিড়িক পড়ে গেছে। ঢাকায় দিনে ৫০-৬০ দম্পতির বিচ্ছেদের আবেদন। এটি একটি খুবই উদ্বেগ ও বেদনার বিষয়। ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণ ও উত্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় বায়ান্ন হাজার। প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টির মতো বিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে। কী ভয়াবহ অবস্থা! যদিও সংবাদে যা এসেছে তা দাপ্তরিক হিসাব। বাস্তবে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। নানা পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান, যা একটি সমাজের জন্য, বিশেষত মুসলিম সমাজের জন্য খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক। কারণ, বিবাহ-বিচ্ছেদের কুফল অনেকদূর পর্যন্ত গড়ায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সমাজে বিয়ে-বিচ্ছেদ প্রবণতার এই ক্রমবর্ধমান বিস্তার কেন? সমাজবিজ্ঞানীরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে যে কথাটি প্রায় সবাই বলছেন তা হচ্ছে- ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব। ইসলামী বিধিবিধান থেকে আমাদের দূরে চলে যাওয়াটাই একটা বড় প্রধান কারণ। ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টি অনেক বিস্তৃত। বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন-দর্শন ও জীবনধারা, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা এই সবই ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। এরপর ইসলামী বিধানমতে, পর্দা রক্ষা, পরপুরুষ বা পরনারীর সাথে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদিও বিশেষ ধর্মীয় অনুশাসন, যা পালন না করাও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি ও বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ। পরিসংখ্যানও বিষয়টিকে সমর্থন করে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের গবেষণা-পরিসংখ্যান বলছে, বিয়ে বিচ্ছেদের যেসব আবেদন ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে পরকীয়ার কারণে। কোনো ক্ষেত্রে স্বামীর পরকীয়া, কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রীর পরকীয়া। কাজেই সমাজবিজ্ঞানীদের কর্তব্য, এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা। কেন এই সমাজে পরকীয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর প্রতিকারের উপায় কী তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন আছে।
পরিসংখ্যানের আরেকটি দিক হচ্ছে,বর্তমান সমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদে পুরুষের চেয়ে নারীরাই এগিয়ে। এক জরিপে দেখা গেছে, ৭০.৮৫ ভাগ তালাক গ্রহণ করছেন নারী আর ২৯.১৫ ভাগ তালাক দিচ্ছেন পুরুষ। এর কারণ হয়তো অনেক ক্ষেত্রে এই যে, সাধারণত নারীরা নির্যাতিত হওয়ায় তারাই বিচ্ছেদের পদক্ষেপ বেশি নিচ্ছে, তবে এর সাথে অনেকেই আরো যা বলছেন তা হচ্ছে, 'মেয়েরা এখন আগের চেয়ে অনেক অধিকার পেয়েছেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই বেশি অধিকার পেয়ে স্বামীকে তালাক দিতে আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। আগেকার দিনের মায়েরা সংসার ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। এখন একক পরিবার হওয়ায় এবং বাইরে চাকরি-বাকরির ও সার্বিক স্বাধীনতার বিস্তার ঘটায় বাইরের মানুষের সাথে তাদের মেলামেশা বেড়েছে এবং স্বামীদের চেয়ে বাইরের বন্ধু-বান্ধবদের দিকে বেশি ঝুঁকছে। তাই পারিবারিক অবস্থা একটু খারাপ হলেই তালাকের চিন্তা করছে নারীরা। তালাকের ব্যাপারে এককভাবে নারীদের দায়ী করা চলবে না। আমাদের সমাজে কিছু লোভী পুরুষ রয়েছে।যারা সবসময় যৌতুকের জন্য নারীদেরকে বেদম প্রহার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে নারীরা অসহ্য হয়ে স্বামীদের ডিভোর্স দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা খুব বেশি অত্যাচারী হয়ে থাকে। এ ছাড়া তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম ও আধুনিক সংস্কৃতির কারণে সংসার ভাঙছে অনেকের। বর্তমানের মেয়েরা বিদেশি টেলিভিশন, স্টার জলসা, জি-বাংলাসহ বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল দেখে সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রভাবিত হচ্ছে। এই কথাগুলো কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নয়। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র। এ দেশের আধুনিক চিন্তাধারার সমাজ-চিন্তকেরাই এই কারণগুলো নির্দেশ করছেন। এখান থেকে বেশ কিছু বিষয় বুঝে আসে। প্রথমত, ইসলামে যে সুসংহত জীবন-ব্যবস্থা রয়েছে, তার প্রতিটি অংশই অতি প্রয়োজনীয়। যে অংশই বাদ দেয়া হবে তার কুফল ভুগতে হবে। ইসলামে আয়-উপার্জন, জীবনমান ও জীবনধারার ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টির শিক্ষা দেয়া হয়েছে। জীবনের বাস্তব প্রয়োজন আর অবাস্তব প্রয়োজনের মাঝেও রেখা টেনে দেয়া হয়েছে। অল্পেতুষ্টির পরিবর্তে যদি সম্পদ ও প্রাচুর্যের মোহ তৈরি হয়, বাস্তব প্রয়োজন ছাড়াও নানা অবাস্তব প্রয়োজনের ভার কাঁধে তুলে নেয়া হয় তখন পরিবারে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তদ্রুপ ইসলামী শিক্ষায় পারস্পরিক হক রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরকে কোনোভাবেই কষ্ট না দেয়া, প্রত্যেকে অন্যের হক রক্ষায় সচেষ্ট থাকা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইসলাম শুধু অধিকারের কথা বলে না, কর্তব্যের কথাও বলে। স্বামী ও স্ত্রী প্রত্যেকেরই রয়েছে কর্তব্য এবং অধিকার। নিজের কর্তব্য পালন আর অন্যের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হলেই সবার শান্তি আসতে পারে। ইসলামী বিধানমতে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের উভয়ের প্রতি ন্যায়সঙ্গত হক ও অধিকার রয়েছে। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে যদি তাদের হক ও অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয় তাহলে সেখানে আল্লাহর তরফ হতে রহমত নাযিল হয়। ঐ পরিবারে কোন অশান্তি আসবে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে, নারীর যেমন কর্তব্য আছে, তেমনি অধিকারও আছে। একই কথা পুরুষের ক্ষেত্রেও। তাই পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কে নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং একে অপরের হক ও অধিকারের বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। পারিবারিক শান্তির জন্য শুধু পরিবারকেন্দ্রিক ইসলামী অনুশাসনগুলোই নয়, সাধারণ অনুশাসনগুলো মেনে চলারও গুরুত্ব আছে। যেমন ধরুন, মাদকাসক্তিও অনেক পরিবারের ভাঙনের একটা কারণ। মাদক ইসলামী বিধানে হারাম। এটি দাম্পত্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়, সাধারণ বিষয়। কিন্তু এর প্রভাব পারিবারিক জীবনেও পড়ে এবং প্রকটভাবেই পড়ে। পরিবারের ভরণ পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পুরুষের। কাজেই পুরুষ বাইরে উপার্জন করবে আর নারী ঘরে সংসার ও সন্তানদের আদব-তরবিয়ত ও প্রাথমিক লেখাপড়ায় সময় দেবে মৌলিকভাবে এটাই স্বাভাবিক পদ্ধতি। এর বিপরীতে নারী-স্বাধীনতা বা নারীর স্বাবলম্বীতার নামে নারীকে উপার্জনে বের করার যে সংস্কৃতি আজ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এর কুফল ইতোমধ্যে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। খোদ সমাজ-চিন্তকেরাই এখন স্বীকার করছেন যে, বিবাহ-বিচ্ছেদের এক বড় কারণ, নারী বাইরে বের হওয়া এবং পর-পুরুষের সাথে মেলামেশা। অথচ অন্য ক্ষেত্রে নারীর স্বাবলম্বীতার তথা বাইরের জগতে বিচরণের বর্তমান ধারার পক্ষে নারী-নির্যাতনের বিষয়টিকে কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এর দ্বারা নারী নির্যাতন তো কমছেই না, বরং বাড়ছে, একইসাথে সংসারও ভাঙছে। কাজেই গোড়া থেকেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। একান্ত আর্থিক সমস্যা ছাড়া নারীদেরকে রোজগারের জন্য ঘরের বাইরে বের করবে না, বরং স্বামীরাই স্ত্রী-সন্তানের খরচাদির ব্যবস্থা করবে। তালাক দেয়ার অধিকার পুরুষের হাতে ন্যস্ত করার যথার্থতাও স্পষ্ট হচ্ছে। ইসলামী বিধানে তালাকের অধিকার পুরুষের হাতে ন্যস্ত করার পাশাপাশি পুরুষকে যে সকল গুণের অধিকারী হওয়ার এবং স্ত্রী ও পরিবার পরিচালনায় যে নীতি ও বিধান অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা পালনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব। ইসলাম স্ত্রীদেরকে ভরণপোষণ আর অধিকার দিয়েছে এবং স্বামী থেকে পাওয়া অধিকার বলে তালাকেরও ক্ষমতা দিয়েছে, যা আমাদের দেশের কাবিননামার ১৮ নং ধারায় উল্লেখ থাকে। সে ধারার গলদ ব্যবহার করেই নারীগণ পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি তালাকের পথে হাঁটছে। এর থেকেই অনুমান করা যায় যে, যদি তারা সরাসরি তালাকের ক্ষমতা পেত, তবে পরিস্থিতি আরো কত ভয়াবহ হতো।
তাই তালাক দেয়ার পূর্বে নারী ও পুরুষদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।সালিশ-সমঝোতাসহ যাবতীয় পূর্ব-পদক্ষেপ বিফল হয়ে গেলে যদি তালাকের পথে যেতেই হয় তবে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেমের পরামর্শ নিয়ে তা করবে এবং কোনোক্রমেই এক তালাকে বায়েনের বেশি দেবে না; যেন পরে সংসার পুনর্বহালের সুযোগ থাকে। পারিবারিক মর্যাদা, মূল্যবোধ, সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের দ্বীন ও ঈমানের হেফাজতের জন্য তালাকের বিষয়ে সংযমী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কথায় কথায় তালাক দেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হলে আমাদের সচেতন হবে। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালাকের কুফল সম্পর্কে বোঝাতে হবে। দেশের প্রতিটি মসজিদের ঈমানগণকে তালাকের কুফল সম্পর্কে মুসুল্লীদের সামনে আলোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে এলাকায় ইসলামী জলসার আয়োজন করে তালাকের কুফল সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
মো. ওসমান গনি : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।