শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনে যা জরুরি
মুক্তা আক্তার
বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চালুকৃত নিত্য-নতুন পদ্ধতিগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে, সেটা আমি বলতে পারছি না। কেন না যুগের চাহিদা অনুযায়ী এই পদ্ধতিগুলো শিক্ষার মান উন্নয়নে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। সম্পূর্ণ পূর্বানুমান এবং ফলাফল পর্যালোচনা ছাড়া কোনো কিছু চালু করলে যে তার ফলাফল খুব একটা ভালো হয় না, আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। প্রতিযোগিতার বা ভালো ফলাফলের জন্য যে শিক্ষা গ্রহণ করা হয়, সে শিক্ষা কোনো কাজে দেয় না। কারণ শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার চর্চা করলে এটা তাদের মেধা বিকাশে সহায়ক হবে না। এমন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে যে শিক্ষা শুধু পরিবর্তন বা প্রতিযোগিতার জন্য নয়, বরং সেটা হবে জ্ঞান অর্জনে সহায়ক এবং সম্পূর্ণ আনন্দমুখর পরিবেশে যা বাস্তব জীবনে চলার পথেও সহায়তা করবে। আর এতে দেশের উন্নয়ন সাধিত হবে।
আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অসহনীয় পরিবর্তন দিন দিন মহামারী আকার ধারণ করছে। ভালোবাসা নিয়ে কেউ আর শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখে না, শিক্ষার্থীদের মনে আজ পড়াশুনা নিয়ে কোনো আবেগ নেই। কেন পড়ছি, কি উদ্দেশ্য নিয়ে পড়ছি, জীবনে এর প্রয়োগই বা কি সে সম্পর্কে নেই কোনো স্বচ্ছ ধারণা। জরাজীর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা এমন একটি পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে চলছে যার ফলাফল মোটেও সন্তোষজনক নয়। আজকের শিক্ষার্থীদের পড়তে ভালো লাগে না, কবিতা আবৃত্তি করতে ভালো লাগে না, খেলাধুলায় নেই কোনো আগ্রহ, হতাশা আর ক্লান্তি জড়ানো কথা শুনে কখনো কখনো চমকে উঠতে হয়। সুন্দর কিছু কল্পনা করার শক্তি হারিয়ে এখন তারা এক রকম নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে। কৌতূহলে চকচক করে ওঠার বয়সটা গাদাগাদা বই আর কৃত্রিম এক পদ্ধতির কাছে কেমন যেন হারিয়ে গেছে। এভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগে ভুল শিক্ষা ব্যবস্থার চাপে আগামী প্রজন্ম সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না। যার দরুন আগামীতে হয়ত মানবতা আর সুন্দর চেতনা নিয়ে জেগে ওঠার শক্তিটুকুও থাকবে না। গন্ধহীন ফুলে যেমন মৌমাছি পড়ে না, তেমনি আনন্দহীন লেখাপড়া শিশুরা শিখতে চায় না। আমার কাছে মনে হয় আনন্দহীন শিক্ষা আর গন্ধহীন ফুলের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নে যোগ হয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতি যা শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু সৃষ্টি করার আগ্রহ তৈরি করার কথা ছিল কিন্তু ঘটছে তার উল্টোটা। শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল পড়াকেও মুখস্থের কাতারে ফেলে দিয়েছে। তাদের একটাই চিন্তা কিভাবে জিপিএ-৫ অর্জন করা যায়। আর জরাজীর্ণ এই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অন্যতম দায়ী শিক্ষকগণ। তারা নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ পড়ায় আগ্রহী করে তুলছে। এজন্য তারা বোর্ড বই রেখে গাইড বই পড়তে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রশ্ন জাগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে? এর থেকে কি কোনো উত্তরণ পাবো না?
দেশে আজ বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। কিছুতেই তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। অথচ তারাই উচ্চ শিক্ষা অর্জনে সার্টিফিকেটধারী। আমাদের পড়াশোনা শুধু সার্টিফিকেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে এর জন্য দায়ী কে? এর জন্য দায়ী বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষা ব্যবস্থা দেশে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে সে শিক্ষা ব্যবস্থা কখনো গ্রহণীয় হতে পারে না। তাই অনতিবিলম্বে এর সমাধান জরুরি। এমন শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে যাতে থাকবে না কেউ বেকার। অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে আরো স্পষ্ট হবে, মালয়েশিয়া ইতোমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করেছে। চীন, জাপান, রাশিয়াতে সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের কার্যকরী কারিগরি শিক্ষা প্রদান করছে এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধি অর্জন করছে ফলে কেউ বেকার থাকছে না। আমি মনে করি, বাংলাদেশ সরকারকেও এমন একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, পদ্ধতির অপরিকল্পিত পরিবর্তন না করে নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে হবে, জোগাতে হবে সাহস, তাদের মাঝে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে হবে, তৈরি করতে হবে আত্মবিশ্বাস এবং কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা কমবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিতে দেশের উন্নয়ন সাধিত হবে।
মুক্তা আক্তার : লেখক
আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন।